রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৩ অপরাহ্ন
কালের খবর প্রতিবেদন :
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘ হতে পারে- এমন আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক মহলে। এর মধ্যদিয়ে সরকার সত্যি সত্যিই মাইনাস ওয়ান ফরমুলার দিকেই এগোচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।
এ আশঙ্কার পক্ষে বেশ কিছু ইঙ্গিত ও উপাদান যুক্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে এমন চারটি মামলায় খালেদা জিয়াকে অ্যারেস্ট দেখানোর প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। নাশকতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগসহ তার বিরুদ্ধে আরও ৩০টি মামলা রয়েছে দেশের বিভিন্ন থানায়।
এছাড়া বিএনপি যতই বলছে খালেদা জিয়াকে ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না, ক্ষমতাসীনরা ততই বলছে, নির্বাচনে যাওয়ার জন্য খালেদা জিয়া কেন অপরিহার্য হয়ে পড়ল?
এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গত রোববার এক সভায় বলেছেন, ‘খালেদা কারাগারে যাওয়ায় বিএনপি যদি আগের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে থাকে তাহলে খালেদাকে ছাড়া তারা নির্বাচনে যেতে চাইছে না কেন? আমরা বিএনপিকে নিয়েই নির্বাচনে যেতে চাই।’ তার আগের দিন ফেনীর মহীপাল সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলেও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। পাশাপাশি বিএনপি নির্বাচনে আসবেই, তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
এদিকে গত শনিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, খালেদা জিয়ার আরও বেশি সাজা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আদালত তার সামাজিক মান-মর্যাদা বিবেচনায় নিয়ে সাজা কম দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি আগেই বুঝতে পেরেছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাঁচার উপায় নেই। তাদের সাজা হবে বুঝতে পেরেই দলটি গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনেছে। খালেদা জিয়ার সাজার মধ্য দিয়ে বিএনপি অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বিএনপির এই মহাসংকট উপভোগ করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি যে বড় ধরনের অগ্নিপরীক্ষায় পড়ছে- তা স্পষ্ট রাজনৈতিক মহলে।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে যেখান থেকে বিএনপির সামনে দুটি পথ থাকবে- একটি হচ্ছে ‘নির্বাচন’ আরেকটি হচ্ছে ‘খালেদার মুক্তি’। খালেদা ছাড়া নির্বাচন নয়- এমন সিদ্ধান্তে অটল থাকলে সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়ে বিএনপিকে ছাড়াই গতবারের মতো নির্বাচন সম্পন্ন করবে। এতে ফের বিএনপি ছিটকে পড়বে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারা থেকে। সেরকম পরিস্থিতিতে সারা দেশের নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আবার নির্বাচনের জন্য দলীয় অবস্থান নমনীয় করলে খালেদার মুক্তির আন্দোলন হয়ে পড়বে অপেক্ষাকৃত ঢিলেঢালা। এ রকম পরিস্থিতিতে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম বিভ্রান্তি, অবিশ্বাস, অনাস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখান থেকে দলে ফাটলও ধরতে পারে।
বিএনপির ভবিষ্যৎ কী হবে না হবে- সেসব ভাববার অবকাশ নেই ক্ষমতাসীনদের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা গত কয়েক দিনে যে বক্তব্যটি বারবার বলার চেষ্টা করছেন, তা হলো- বিএনপিকে ছাড়া তারা আগামী নির্বাচনে যেতে চান না। তারাও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না- এ বক্তব্যকে মানতে চাইছেন না। তারা বলছেন, আইনের কারণে যদি খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য হন, তার দায় সরকার কেন নেবে?
সাদা চোখে সরকারের এ অবস্থান যৌক্তিক মনে হলেও খালেদার বিরুদ্ধে মামলা, বিচার এবং রায়- এর প্রত্যেকটির পেছনে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও প্ররোচনা আছে বলে দাবি করেছে বিএনপি।
বিএনপি বলেছে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায়ের জন্য সরকার আদালতকে ব্যবহার করেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা দাবি করেছেন, সরকার এখন ‘মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা’ বাস্তবায়ন করতে চাইছে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচনী মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে ফের ২০১৪ সালের মতো একতরফা নির্বাচনের দিকে পা বাড়াচ্ছে সরকার। বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে- খালেদা জিয়াকে ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে অস্তিত্ব সংকটে পড়া বিএনপির দ্বৈরথ পর্যবেক্ষণ করছেন। সামরিক ব্যারাক থেকে জন্ম নেওয়া বিএনপি নামের দলটির প্রতি আজন্ম ক্ষোভ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচার চালিয়েছে বিএনপি ও তার মিত্ররাই।
আওয়ামী লীগের মতো সেক্যুলার ও উদার জাতীয়তাবাদী দলটিকে নিশ্চিহ্ন করতে বিএনপির নেতৃত্বেই এ দেশে সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে হৃষ্টপুষ্ট করা হয়েছে বলে দাবি আওয়ামী লীগসহ অন্য প্রগতিশীল দলগুলোর। শুধু তাই নয়, গত বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাকালে তারা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার একাধিক চেষ্টা করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষ করে খালেদাপুত্র তারেক জিয়ার যোগসাজশে ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা আদালতে প্রমাণিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ আরও দৃঢ়কণ্ঠ যে, খালেদা ও তারেক রহমানই শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন বক্তৃতায় এ কথা উঠে এসেছে বহুবার। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান বর্তমানে পালিয়ে আছেন যুক্তরাজ্যে।
কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েই বিএনপিকে ধরাশায়ী করেছে। আইনি কোনো ধরনের ফাঁক তারা রাখছে না। অনেকে বলছেন, সঙ্গত প্রতিশোধস্পৃহাও শেখ হাসিনাকে পেয়ে বসেছে। এছাড়া গত জাতীয় নির্বাচনে না গিয়ে যে পরিস্থিতি বিএনপি-জামায়াত সৃষ্টি করেছিল, তাতে আওয়ামী লীগকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সে পরিস্থিতি উৎরে এখন আওয়ামী লীগ আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী এবং বেপরোয়া।
খালেদা জিয়া বা বিএনপিকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় না দিয়ে তারা আগামী নির্বাচন সম্পন্ন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীনদের অবস্থান এমন- আদালতের সিদ্ধান্তে খালেদা যদি নির্বাচনের যোগ্য হন তো হবেন, না হলে নেই। এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচনে এলে আসুক, না এলেও ক্ষতি নেই। সংবিধান অনুযায়ী সময়মতোই নির্বাচন সম্পন্ন হবে।
দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড পাওয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনেকটাই অনিশ্চিত বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কোনো প্রার্থীর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হলে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২)(ঘ) উপ-অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি নির্বাচন করতে পারেন না। এ অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার ব্যাপারে বলা হয়েছে- নৈতিক স্খলনজনিত কারণে কেউ কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যদি দুই বছরের বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয় তবে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হবেন।
তবে যদি উচ্চ আদালতে আপিল আবেদন গৃহীত হয় এবং উচ্চ আদালত সাজা পরিবর্তন ও রায় স্থগিত করেন সেক্ষেত্রে নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। এখন খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি নির্ভর করছে তার আপিল গ্রহণ ও আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। মামলার গতিপ্রকৃতি এবং সরকারের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে- খালেদার ভাগ্যে কী ঘটবে সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই সরকারের। সরকার চাইছে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তাতে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে ভালো না করলেও কোনো সমস্যা নেই।
পক্ষান্তরে বিএনপি চাইছে খালেদার মুক্তি ও সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। খালেদার মুক্তির বিষয়টি এখন পুরোটাই আদালতের বিষয়। আর নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপি কী ধরনের দর কষাকষি করবে- সেটিই দেখার বিষয়।
বড়সড় আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের কোনো ধরনের বাস্তব পরিস্থিতি বা সাংগঠনিক শক্তি বিএনপির এই মুহূর্তে নেই বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। ফলে সরকারের সব শর্ত মেনে এবং খালেদা জিয়াকে রেখেই নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে আর পথ খোলা নেই বলে মনে করছেন তারা।
কালের খবর/২০/২/১৮